Sunday, December 25, 2011

পলিথিন ব্যাগ বনাম পরিবেশ রক্ষা: পলিথিন ব্যাগ মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আইনের বাস্তবিক প্রয়োগ প্রয়োজন


বিশ্বে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা ও ১ মার্চ সারাদেশে পরিবেশ রক্ষায় পলিথিনের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। মূলত ১৯৯৮ সালের বন্যায় পলিথিনের বহুল ব্যবহারের কারণে দেশের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০০২ সালে নিষিদ্ধ হবার পর জোরালো অভিযান ও আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে পলিথিনের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল।

কিন্তু পরবর্তীতে ২০০৬ সালের শেষ দিকে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সময় থেকে এ ব্যাপারে নজরদারী শিথিল হয়ে পড়ায় পুনরায় দাপটের সাথে  পলিথিনের আবির্ভাব ঘটে। বিগত বছর খানেক ধরে পলিথিনের ব্যবহার আবারো মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে কাঁচাবাজার, খুচরা পণ্য ক্রয় ও ফলের দোকানে পুরো মাত্রায় পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় দেদারসে পলিথিন বিক্রি ও ব্যবহৃত হলেও আইনের যথাযথ ও কঠোর প্রয়োগের অভাবে পলিথিন উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করা যাচ্ছে না। সেই সাথে এ ব্যাপারে ভোক্তাশ্রেণীর অসচেতনতাও মদদ জুগিয়ে চলছে।

পলিথিনের ইতিকথাঃ পলিইথিলিন, যা জনপ্রিয়ভাবে পলিথিন নামে পরিচিত তা আসলে এক ধরনের পলিমার বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার যোগ্য পলিথিন প্রথম ১৯৩৩ সালে আবিস্কৃত হলেও এর ব্যবহার মূলত জনপ্রিয়তা পায় ১৯৫৮ সাল থেকে। দামে সস্তা ও সহজ ব্যবহার উপযোগিতা একে মুহূর্তেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়। বর্তমানে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৬০ মিলিয়ন টন পলিথিন সামগ্রী উৎপাদিত হয় পলিমার একটি শক্ত, সাদা স্বচ্ছ বস্তুএর বহুবিধ ব্যবহারের মধ্যে পণ্যের মোড়ক, বোতল, খেলনা, বৈদ্যুতিক কেবল, পাইপ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্যবর্তমানে দুই ধরনের পলিথিন উৎপাদিত হয়- কম ঘনত্বের কোমল পলিথিন এবং উচ্চ ঘনত্বের পলিথিনপলিথিন তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় অপরিশোধিত খনিজ তেল
পলিথিনের নানামুখি ক্ষতিকর দিকঃ পরিবেশ ও মানব স্বাস্থের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে এটি এক নতুন অভিশাপ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণানুযায়ী একটি পলিথিন ব্যাগ প্রকৃতিতে মিশে যেতে সময় নেয় পাঁচশ থেকে হাজার বছর পর্যন্ত  ২০০২ সালের পূর্বে করা এক সমীক্ষা অনুযায়ী ঢাকা শহরের একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করতো এবং শহরের বাসিন্দারাই প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি পলিথিনব্যাগ একবার ব্যবহার শেষে প্রকৃতিতে যথেচ্ছভাবে ফেলে দিতো। নিষেধাজ্ঞা জারির পূর্বে বাংলাদেশে চারশত পলিথিন কারখানা প্রতিদিন গড়ে ১৩০ মিলিয়ন পলিব্যাগ উৎপাদন করতো।

পণ্যের সাথে বিনামূল্যে দেয়া এসব পলিথিন ব্যাগগুলো দ্রুত সারাদেশের ড্রেন, নালা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট করে ফেলে এবং পানির প্রবাহ থামিয়ে দেয়এর ফলে দেখা দেয় দুই প্রকারের সমস্যা:  ক) জলাবদ্ধতা ও বন্যা এবং খ) জনস্বাস্থ্য সমস্যাপলিথিন থেকে সৃষ্ট এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া ক্যান্সার ও ত্বকের বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করেতাছাড়াও ডায়রিয়া ও আমাশয় রোগও ছড়াতে পারেরঙিন পলিথিন জনস্বাস্থ্যের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকরএতে ব্যবহৃত ক্যাডমিয়াম শিশুদের হাড়ের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়পলিথিনের কাপে চা পান করলে আলসার ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে অন্যদিকে পলিথিনের প্রভাবে মাটির চারটি উপাদান সমভাবে সংবন্ধিত হতে পারে নাফলে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়এতে বৈচিত্র্য নষ্ট হয়

পলিথিন কৃষি জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেপলিথিন পুঁতে যাওয়ার ফলে মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে না মাটির নিচে পানি চলাচলেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়এর ফলে মাটির স্বাভাবিক কাজগুলো ব্যাহত হচ্ছেপলিথিন পোড়ানোর ফলে ডাইঅক্সিন নামক বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়, যা নিচের বায়ুস্তরকে দূষিত করেবর্জ্য পলিথিন ড্রেনেজ প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করেপলিথিন জমা হওয়ায় এবং সূর্যালোক না পৌছাতে পারায় অ্যাকুয়াটিক সিস্টেম নষ্ট হয়ফাইটোপ্লাংটন সৃষ্টি না হওয়ায় পানির বাস্তুসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়ফলে বৈচিত্র্য নষ্ট হয় এক হিসাব অনুযায়ী ঢাকা শহরের শতকরা আশিভাগ ড্রেনে বন্ধের কারণ হচ্ছে পলিব্যাগবাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী পলিথিনসহ বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ জমা হয়ে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর ১০-১২ ফুট পর্যন্ত ভরাট হয়ে নাব্যতা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে

পলিথিন রুখতে আইনের বিধানঃ ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৬(ক) (সংশোধিত ২০০২) ধারার প্রদত্ত ক্ষমতা বলে ঘোষিত সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, যে কোনো প্রকার পলিথিন ব্যাগ অর্থাৎ পলিথাইলিন, পলিপ্রপাইলিন বা উহার কোনো যৌগ বা মিশ্রণের তৈরি কোনো ব্যাগ, ঠোঙা বা যে কোনো ধারক যাহা কোনো সামগ্রী ক্রয়বিক্রয় বা কোনো কিছু রাখার কাজে বা বহনের কাজে ব্যবহার করা যায় উহাদের উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সমগ্র দেশে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হইল প্রজ্ঞাপনটিতে আরো উল্লেখ করা হয় সাময়িকভাবে বিস্কুট চানাচুরসহ বিভিন্ন রকম খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ, সিমেন্ট, সার শিল্পসহ মোট ১৪টি পণ্যে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা যাবেতবে ১০০ মাইক্রোনের কম পুরুত্বের পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন করা যাবে না

ই আইনের ১৫(১) এর ৪(ক) ধারা অনুযায়ী উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণের জন্য অপরাধীদের সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা ৬ মাসের কারাদণ্ডের বিধান আছে আইনানুযায়ী মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড প্রদান করলেও পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে না

পলিথিনের উৎস ও ব্যবহারের কারণঃ আইন করে নিষিদ্ধ করার পরও পুরান ঢাকার লালবাগ ও চকবাজারে পলিথিন ব্যাগের রমরমা ব্যবসা চলছে  বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন রঙ ও সাইজের পলিথিন ব্যাগ সেখানে পাইকারি ও খুচরা দামে কিনতে পাওয়া যায়দোকানগুলোতে সামান্য কিছু পরিমাণ পলিথিন ব্যাগ রাখা থাকলেও অর্ডার দিলে যে কোনো সাইজের ও রঙের পলিথিন ব্যাগ তারা ক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করে বলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত একাধিকবার অভিযান চালিয়ে অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় চকবাজারে এইচডিপি পলিথিন প্রতি পাউন্ডের দাম পড়ে ৫৫ টাকাএছাড়া এর চেয়ে উন্নতমানের হাতলওয়ালা পলিথিন তারা বিক্রি করে প্রতি পাউন্ড ৭০-৮০ টাকায়চকবাজারের পাইকারি পলিথিন ব্যাগের দোকানগুলো সারাদেশের খুচরা ও পাইকারি ক্রেতাদের কাছে পলিথিন ব্যাগ সরবরাহ করে থাকে

বাংলাদেশ পলিপ্রোপাইল প্লাস্টিক রোল অ্যান্ড প্যাকেজিং অ্যাসোসিয়েশন নামে বৃহৎ একটি পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে সারাদেশে এক হাজার পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনকারী ছোট-বড় অবৈধ কারখানা রয়েছেএর মধ্যে ৭শটি কারখানা ঢাকাসহ পুরান ঢাকার কোতোয়ালি, চকবাজার, সূত্রাপুর, বেগমগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে অবস্থিতএছাড়া ঢাকা শহরের মিরপুর, কারওয়ানবাজার, তেজগাঁও, কামরাঙ্গীরচর ও টঙ্গীতেও প্রচুর ছোট-বড় পলিথিন কারখানা রয়েছেবাকি কারখানাগুলো চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যান্য জেলায় অবস্থিত

খরচ কম হওয়ায় ব্যবসায়ীরা ব্যাপক হারে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করলেও এ ব্যাপারে ক্রেতারা সচেতন না হওয়ায় বাড়ছে পলিথিন ব্যাগের ব্যাপক ব্যবহার অধিকাংশ ক্রেতা দ্রব্য ক্রয়ের পর কোন ধরনের পাত্রে বিক্রেতা পরিবেশন করছে তার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে নাবিক্রেতা পলিথিন ব্যাগে ভরে পণ্য দিলেও তাতে ক্রেতারা আপত্তি করছে নাআবার রাস্তাঘাটে খোলাবাজারে অবাধে চলছে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার ও পরিবহনবেশিরভাগ ক্রেতাই বাজার করতে ব্যাগ নিয়ে আসেন নাআর দামে সস্তা হওয়ায় এবং হাতের কাছে পাওয়া যায় বলে ক্রেতারাও পলিব্যাগ ব্যবহারে উৎসাহ বোধ করেননেট অথবা কাগজের ঠোঙায় যেখানে এক টাকার বেশি খরচ হয়, সেখানে পলিথিনে খরচ হয় চার ভাগের এক ভাগ এটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

পরিবেশ বাঁচাতে অবশ্যই পলিথিন ব্যাগের বিকল্প পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে এবং পলিথিনের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবেপলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাট, কাগজ বা  কাপড়ের ব্যাগ উদ্ভাবনের ও বহুল ব্যবহারের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহ ও বিভাগগুলোকে  কার্যকরভাবে উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ঘন ঘন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং এ সংক্রান্ত বাধাগুলি দূর করতে হবে।

সরকারিভাবে  বাজারগুলোতে নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা করা গেলে পলিথিন ব্যবহারে রাশ টেনে ধরা সম্ভব পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে  সচেতন করা গেলে এবং পলিথিন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের পুনর্বাসনের বাস্তবিক ব্যবস্থা করা গেলে পলিথিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়া অসম্ভব কিছু নয়।

Thursday, December 15, 2011

খুনি নূর চৌধুরী ও অন্যদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের করণীয়


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসাম মেজর (অব.) নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে আবার অস্বীকৃতি জানিয়েছেন কানাডা রাষ্ট্রদূত হিদার ক্রুডেনঢাকায় নিযুক্ত কানাডার এই হাইকমিশনার গত ০৪ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে এ কথা জানান। এ সময় তিনি বলেন আমাদের সরকারের নীতি খুব স্পষ্টকোনো ব্যক্তি তার দেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হলে আমরা তাকে সেখানে ফেরত পাঠাই না

এ এইচ এম বি নূর চৌধুরকানাডায় ২০০৭ সালে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে প্রাথমিক আবেদন করলে প্রথমে তা প্রত্যাখান করা হয়। পরবর্তীতে তিনি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন। এর আগে বঙ্গবন্ধুর এই খুনীকে ফেরত পাঠাতে দীপু মনি বিগত ৫ অক্টোবর কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন বেয়ার্ডকে চিঠি পাঠিয়েছিলেনএ ছাড়া নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার অংশ হিসেবে সম্প্রতি সরকার টরিস এলএলপিকে নিয়োগ দিয়েছেটরন্টোভিত্তিক এই আইনি পরামর্শক সংস্থা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কানাডার আদালতে আইনি লড়াই করবে

আন্তর্জাতিক আইন ও রীতি অনুসারে এবং আন্তঃদেশীয় সম্প্রীতি অক্ষুন্ন রাখতে কানাডা খুনি নূরকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী বন্দি বিনিময় একটি স্বীকৃত নীতি। এমনকি কোন বন্দি বিনিময় চুক্তির অনুপস্থিতিতে কেবলমাত্র স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পারস্পারিক সমঝোতার ভিত্তিতেও বন্দি বিনিময় হতে পারে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশের সঙ্গে এবং বাংলাদেশও বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন সময় বন্দি বিনিময় চুক্তির অনুপস্থিতিতেই বন্দি সন্ত্রাসীদের বিনিময় করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে এ ব্যাপারে অনেক অগ্রগতিও পরিলক্ষীত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক রীতি (Convention) অনুযায়ী দুটি দেশের মাঝে বন্দি বিনিময় চুক্তি (Extradition Treaty) বিদ্যমান থাকলে তারা নিজেদের মধ্যে বন্দি বিনিময় করতে বাধ্য। বহিঃসমর্পণ-সংক্রান্ত ১৯৩৩ সালের Montevideo Treaty-তে বলা হয়েছে, এ চুক্তি থাকলে দুই দেশের মধ্যে বন্দিকে নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়া বা বহিঃসমর্পণে বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়যে অপরাধের জন্য বহিঃসমর্পণ চাওয়া হয় তা মারাত্মক ও গুরুতর এবং উভয় রাষ্ট্রে অপরাধ হতে হবেনরহত্যা বাংলাদেশের আইনে যেমন অপরাধ, কানাডার আইনেও তা-ই বাংলাদেশে যেখানে দণ্ডবিধিতে হত্যার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের উল্লেখ রয়েছে, কানাডায় সেখানে ফৌজদারি অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান ১৯৭৬ সালে বাতিল করকারাদণ্ডের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে

তবে কানাডার স্থানীয় আইনানুযায়ী এমন কোনো আসামকে বহিঃসমর্পণ (Extradite) করা যাবে না, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে কানাডা এখন তাদের আভ্যন্তরীণ এই আইনি বিধানের দোহাই দিয়ে নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে সমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিধি-বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কানাডাকে খুনি-সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্য না বানিয়ে কেবলমাত্র ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে কানাডা এ কাজে আমাদের সহযোগিতা করতে পারে।

এছাড়াও যদি নিগ্রহ (Persecution) থেকে রক্ষা পেতে অন্য দেশে আশ্রয়প্রার্থনা ও তা ভোগ করার মানবাধিকারের বিষয়টি (দেখুনঃ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ১৪ অনুচ্ছেদ) আমলে নেয়া হয় তাহলে দেখা যায় শরণার্থীর মর্যাদাবিষয়ক জাতিসংঘ সনদ (১৯৫১ অতিরিক্ত চুক্তি (প্রটোকল) ১৯৬৭) অনুসারে নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে কোনো একজন ব্যক্তি শরণার্থীর মর্যাদা পেতে পারেন:
১. জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম, জাতীয়তা, নির্দিষ্ট সামাজিক গোষ্ঠীর সদস্যপদ কিংবা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে নিগ্রহের ভীতি থাকলে; ২. যিনি আগে থেকেই নিজ দেশের বাইরে অবস্থান করছেন এবং ৩. যিনি নিজ দেশের নিরাপত্তা পেতে অপারগ অথবা অনিচ্ছুক অথবা নিগ্রহজনিত ভীতির কারণে সংশ্লিষ্ট দেশে ফেরত যেতে চান নানূর চৌধুরী বা বঙ্গবন্ধুর অন্য খুনিদের বেলায় এর কোনটিই প্রযোজ্য নয়

যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার শরণার্থীসংক্রান্ত আইনে শরণার্থীর সংজ্ঞা ১৯৫১ সালের সনদেরই অনুরূপঅধিকন্তু, কানাডা ১৯৬৭ সালে ১৯৫১ সালের শরণার্থী সনদ অনুসমর্থন করায় তা তাদের ওপর বাধ্যকরি এবং জাতীয় (দেশীয়) আইন দ্বারা এই আন্তর্জাতিক সনদের কোন বিধান রহিত করা যাবে না। তবে কোনো ব্যক্তি শরণার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন (এমনকি উপরোল্লিখিত কারণে নিগ্রহের ভীতি থাকা সত্ত্বেও)-যদি তিনি শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ অথবা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (আন্তর্জাতিক আইনের বর্ণনামতে) করে থাকেন; আশ্রয়প্রার্থনার দেশে আসার আগে যদি অন্যত্র গুরুতর অরাজনৈতিক (Serious non-political) অপরাধ করে থাকেন; কিংবা তিনি যদি এমন কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকে থাকেন, যা জাতিসংঘের উদ্দেশ্য ও নীতির বিরুদ্ধে যায় (দেখুনঃ শরণার্থীসংক্রান্ত সনদের ১ (এফ) অনুচ্ছেদ) যেহেতু মেজর (অব.) নূরসহ অন্যান্য খুনিরা (যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে) খুনের দায়ে উপযুক্ত আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত তাই এই আইনের আওতায় তারা কোনরূপ সুরক্ষাতো পাবেই না এমনকি নিজেদের শরণার্থী দাবি করেও আশ্রয় চাইতে পারবে না।

অন্যদিকে লাতিন আমেরিকার নীতিনুযায়ী কোনো রাষ্ট্র যদি কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বহিঃসমর্পণ না করে, তবে সেই রাষ্ট্রকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে তার বিচার করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পারছি কানাডা একটি দেশের আইনানুযায়ী সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত (আপিলের সুযোগসহ) কোন আসামীর বিচারতো তাদের দেশে করছেই না উপরন্তু তার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছে। এ ধরনের খারাপ নজির প্রতিষ্ঠিত হতে থাকলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের এই দুনিয়ায় সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে উৎসাহিত হবে এবং সন্ত্রাসের রাশ টেনে ধরতে এই সকল রাষ্ট্রকেই তখন বেগ পেতে হবে। এমনকি এই অনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্তরা তাদের জন্যই হুমকি হয়েও আবির্ভূত হলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। তাই সামগ্রিক বিবেচনায়ও কানাডার স্বীকৃত দণ্ডপ্রাপ্তদের আশ্রয় প্রদান করা সমীচীন হবে না।

১৯৭৫-এর হত্যাযজ্ঞকে কানাডা বা অন্য কোন পরাক্রমশালী রাষ্ট্র রাজনৈতিক হত্যা বলেও দায় এড়াতে পারে না। কারণ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্থপতি ও জাতির পিতাকে স্বপরিবারে রাতের আঁধারে নৃশংসভাবে হত্যা করাকে কেবল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। তাছাড়া সন্ত্রাসবাদের বেলায় বলা হয়ে থাকে সন্ত্রাস একটি ফৌজদারি অপরাধ, রাজনৈতিক অপরাধ নয়’ (দেখুনঃ France vs UK, Q.B.D. 1894)১৯৮৮ সালে স্বাক্ষরিত ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বহিঃসমর্পণ চুক্তি অনুযায়ী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশেষ করে রাষ্ট্রনায়কদের হত্যা রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় নাএই চুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক হত্যাও জঘন্যতম অপরাধতাই এ অপরাধও বহিঃসমর্পণযোগ্য হিসেবে গণ্য হবেশেখ মুজিব হত্যা মামলার অন্যতম আসামি মেজর (অব.) বজলুল হুদাকে থাইল্যান্ড থেকে বহিঃসমর্পণের জন্য বাংলাদেশ দাবি জানালে জনাব হুদার আইনজীবী বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিকচিহ্নিত করে বহিঃসমর্পণের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখানথাইল্যান্ডের আদালত এক্ষেত্রে হত্যাকে রাজনৈতিক হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে তাকে বিচারের জন্য বাংলাদেশে বহিঃসমর্পণ করেছিল

যদিও শরণার্থীর মর্যাদাবিষয়ক জাতিসংঘ সনদ নিগ্রহের কোনো সংজ্ঞা দেয়নি তথাপি যুক্তরাষ্ট্রের নবম সার্কিট কোর্ট ঘালি বনাম আইএনএস (১৯৯৫) মামলায় নিগ্রহের সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে-‘The infliction of suffering or harm upon those who differ (in race, religion or political opinion) in a way regarded as offensive.’
অর্থাৎ কাউকে যদি জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রভৃতির কারণে এমনভাবে যন্ত্রণা দেওয়া হয় কিংবা ভোগান্তির শিকার করা হয়, যা অনভিপ্রেত বলে বিবেচিত হবে, তাই নিগ্রহ এই নিগ্রহ  স্বাভাবিকভাবে সমাজে অনভিপ্রেত বলে বিবেচিত আচরণের চেয়ে চরমতম

কানাডার অভিবাসী ও শরণার্থী সুরক্ষা আইন, ২০০১ অনুসারে কোনো ব্যক্তি শরণার্থীবিষয়ক জাতিসংঘ সনদের ১ (ই) ও (এফ) অনুচ্ছেদের বিধানমতে শরণার্থী হওয়ার অযোগ্য হলে কানাডার আশ্রয়প্রার্থনার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে এছাড়া এই আইনআনুসারে, মানবাধিকার তথা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অধিকার লঙ্ঘনকারী ব্যক্তিদের কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া ওপরও নিষেধাজ্ঞা য়েছে

যদিও এই হত্যা মামলায় ইতমধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ ও মহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি কার্যকর করা হয়েছে, তথাপি নূর চৌধুরী ও এম রাশেদ চৌধুরী (যিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে) ছাড়াও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, আবদুল মাজেদ ও মোসলেমউদ্দিন এখনো পলাতক রয়েছেন

যে বিশ্বজনীন সন্ত্রাসবাদ নিয়ে বর্তমান কানাডা, আমেরিকা কিংবা ইংল্যান্ডের মাথাব্যাথা সেই সন্ত্রাসবাদের এমন নগ্ন প্রতিপালন তাদের মানায় না। আজ যদি বাংলাদেশ তাদের কোন মহান অধিপতির হত্যাকারীর আশ্রয়ক্ষেত্র হতো (যদিও চাইনা বিশ্বের কোন ভূ-খণ্ডই কোন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র হোক) তাহলেতো মুহূর্তেই বাংলাদেশর আফগানিস্স্তান, ইরাক অথবা লিবিয়ায় পরিণত বরণ করে নিতে হতো।

এখন কানাডা যেহেতু খুনি নূরকে সমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে তাই সরকারকে এ ব্যাপারে কৌশলী হতে হবে। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে দুরাস্ট্রের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। কানাডা বা যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের সঙ্গে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যেসব বিষয় আছে সেখান থেকে কূটনৈতিক চাপে ফেলতে হবে।

প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা কামনা করা যেতে পারে। তাতে কাজ না হলে জাতিসংঘ কিংবা আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে। সরকারের আইনের শাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার  যে ব্রত তা সামনে নিয়া আসতে হবে।  বৈশ্বিকভাবে প্রচারণা চালিয়া সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে হবে। অপরাধীদের অপরাধের ভয়াবহতা এবং নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে বিশ্বমহলকে জ্ঞাত করতে হবে। দোষীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সাহায্য কামনা করা যেতে পারে। এ ধরনের অযাচিত আশ্রয় প্রদানের ভবিষৎ ক্ষতিকর প্রভাব সম্বন্ধে বহিঃবিশ্বকে সজাগ করতে হবে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলিকে বোঝাতে হবে যে, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া মেনে ও সুযোগ প্রদান করে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে এবং বিচারিক প্রক্রিয়া স্বচ্ছভাবে সম্পাদিত হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্তরা কোনরূপ রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার হয়নি বরং আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে তাদের দণ্ড কার্যকর করা অত্যাবশ্যক। এমনকি দণ্ডপ্রাপ্তরা আইনি বিধান সাপেক্ষে মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন, রিভিউ এবং রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা চাওয়ার সুযোগ পাবে। 

আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী কানাডা বাংলাদেশের নিকট খুনি নূর চৌধুরীকে দিতে বাধ্য এবং তার বিচার কার্যকর করার সুযোগ না দিলে তা আইনের লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে। এতগুলো যুক্তি সুচারুরূপে উপস্থাপন করার পরও কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য রাষ্ট্রগুলিকে (যেসব রাষ্ট্রে দোষীরা পালিয়ে আছে) বন্দি বিনিময়ের ব্যাপারে রাজি করানো না গেলে বন্দিদের অন্য কোন তৃতীয় দেশে হস্তান্তরের প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে এবং সেখান থেকে তাদের বাংলাদেশে প্রত্যার্পন করানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাতেও কাজ না হলে দোষীদের বিরুদ্ধে অন্যকোন অভিযোগ থাকলে (যে অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়) তার বিচার করে সে বিচারের রায় কার্যকর করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ও কার্যকর করা যেতে পারে।

Beyond the Gavel: The Twists of Prenatal Sex Detection

  In a recent decision, a divisional bench of the High Court Division (HCD) has imposed embargo on pre-natal sex detection in Bangladesh in ...