Sunday, March 4, 2012

গৃহশ্রমিকদের অধিকার কতদূর...

গৃহশ্রমিকের ওপর নির্যাতন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু দিন দিন গৃহশ্রমিকদের প্রতি পাশবিক অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১০ বছরে গৃহশ্রমিকের ওপর ৭৯৮টি নির্যাতনের ঘটনায় ৩৯৮ জন মারা গেছে। শুধু গত বছর ১২ অক্টোবর পর্যন্ত মারা গেছে ৩৩ জন।
গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন এ রকম একেকটি পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে। তার মধ্যে গৃহকর্মী শিশু হাসিনা (১১), তানিয়া আক্তার (১০), রোমেলা খাতুন (১০), রাশিদা বেগমের (২৪) ওপর চালানো শারীরিক নির্যাতন আমাদের হতবিহ্বল করে দেয়। হাসিনার শরীরের প্রতিটি ইঞ্চিতে ছিল জখমের চিহ্ন। রোমেলা নির্যাতনের শিকার হয় সীতাকুণ্ড থানার উপ-পরিদর্শক শাহেদ আলী ও তার স্ত্রী সুইটি বেগমের বাসায়। রোমেলা বলেছে, একবার পিটুনিতে মুখ কেটে গেলে সুইটি বেগম সুঁই-সুতো দিয়ে তা সেলাই করে দেয়। তানিয়ার তো জীবনপ্রদীপই নিভে গেল। সর্বশেষ গত ১৬ ডিসেম্বরে রাশিদা বেগমকে রাজধানীর শাহবাগ থানার আনন্দবাজার এলাকায় একটি বাড়ির তিন তলা থেকে ফেলে হত্যার অভিযোগ পাওয়া যায়। কাজ করতে দেরি হওয়ায় গৃহকর্ত্রী রাশিদাকে তিন তলা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।
এভাবে একের পর এক গৃহকর্মী নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে। নির্যাতনকারী বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী হওয়ায় দরিদ্র, অসহায় নির্যাতিত এসব মানুষ নূ্যনতম বিচার পাচ্ছে না। যেন গৃহশ্রমিকরা মানুষ নয়, তারা যেন মালিকের কেনা সম্পত্তি।
দেশের সিংহভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্র ও অসহায় জনগোষ্ঠী জীবিকার তাগিদে গৃহকর্মে সহযোগিতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা অসহায়, বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্ত নারী অথবা মেয়ে শিশু। ২০০৬ সালে পরিচালিত এক জরিপ থেকে জানা যায়, দেশে যে ২ মিলিয়ন শিশু শ্রমভিত্তিক কাজে নিয়োজিত তার মধ্যে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ গৃহকর্মে নিয়োজিত। এদের মধ্যে ৭৮ শতাংশই মেয়ে শিশু এবং ৯৪ ভাগ পূর্ণকালীন কাজ করে। ধারণা করা হচ্ছে, দেশে বর্তমানে গৃহশ্রমিকের সংখ্যা ২০ লাখের বেশি।
তারা কাজ করে দিনে প্রায় ১১-১২ ঘণ্টা। কাজের তুলনায় এদের বেতন খুবই সামান্য। ৬০ শতাংশ নিয়মিত বেতন পায়, বাকি ৪০ শতাংশ অনিয়মিত। এসব গৃহশ্রমিক দিনভর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও বিনিময়ে কিছু সুযোগ-সুবিধা তো দূরের কথা, সহানুভূতিটুকুও পায় না। গৃহকর্মীদের কাজের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। কাকডাকা ভোরে তারা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মধ্যরাতে অবসর মেলে। অসুস্থ অবস্থায় এমনকি গর্ভকালীন অবস্থায়ও তাদের ছুটি মেলে না। তাদের নেই ট্রেড ইউনিয়ন করার বিধান। বাংলাদেশের শ্রম আইন গৃহশ্রমিককে শ্রমিকের অন্তর্ভুক্ত করেনি। গৃহপরিচারিকাদের কাজের সময় কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। তাই মালিকের ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির ওপর চাকরি নির্ভর করে।
বিলসের সূত্র অনুযায়ী, গৃহকর্মীদের রাত যাপনের নির্দিষ্ট কোনো ঘর নেই। পত্রিকার পাতা খুললে প্রায় দিনই গৃহকর্মীদের ওপর যৌন নিপীড়নের খবর পাওঢা যায়। সিংহভাগ ক্ষেত্রে এর জন্য দায়ী গৃহকর্তা বা তার কোনো আত্মীয়। কালেভদ্রে যৌন নিপীড়ন বা শারীরিক নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হলে লোক দেখানো চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং অর্থের বিনিময়ে আপসের ব্যবস্থা করা হয়। শিশু গৃহকর্মী সারাক্ষণ কাজের মধ্যে থেকে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত বঞ্জিত হচ্ছে।
গৃহকর্মীদের জন্য দেশে একটি মাত্র আইনই বিদ্যমান। তাও নিবন্ধন সংক্রান্ত। এ আইনের অধীনে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়। আইনটি সম্বন্ধে অনেকে জানেনও না। আইনটি হলো গৃহপরিচারিকা নিবন্ধন অধ্যাদেশ-১৯৬১। আইনটি শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশনে প্রযোজ্য। আশার কথা, সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালে এনজিও কর্মীদের সমন্বয়ে গৃহশ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকারের সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে 'গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা' নামে খসড়া একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। খসড়া প্রণয়নের ২ বছর অতিক্রান্ত হলেও বিবিধ অজুহাতে সরকার এখনও খসড়া নীতিমালাটি কার্যকর করছে না। নীতিমালা অনুযায়ী, ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে গৃহকাজে নিয়োগ করা যাবে না। কোনো গৃহকর্মীকে তালাবদ্ধ করে রাখা যাবে না। তবে তার নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বাড়ি তালাবদ্ধ করতে হলেও একটি চাবি তার কাছে রাখতে হবে।
বয়স ও সামর্থ্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্য বিবেচিত ভারী ও বিপজ্জনক কাজে কিশোর-কিশোরীদের নিয়োগ করা যাবে না। দেশের সব সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর কার্যালয়, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ গৃহশ্রমিকদের নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবে। নীতিমালায় গৃহকর্মীর ছবিসহ পরিচয়পত্র ও সপ্তাহে কমপক্ষে এক দিন ছুটির কথা বলা হয়েছে। গৃহকর্মী হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হলে সুবিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। গর্ভকালীন ও প্রসূতিকালীন সুবিধা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করার কথাও নীতিমালায় বলা আছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত নারীর এ গৃহশ্রম ও পরিবারকে ভালোবেসে যে শ্রম প্রদান করে তাকে 'ভালোবাসার অর্থনীতি' আখ্যায়িত করে ভালোবাসার অর্থনীতির আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করেছেন প্রায় ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। জিডিপিতে এই মূল্যমান যোগ করা হলে জিডিপি বেড়ে দাঁড়াবে ৭ লাখ ১৭ হাজার ১২ কোটি টাকা। এ হিসাবের ভিত্তি হলো বাংলাদেশে ১০ বছর ও তদূর্ধ্ব নারীরা গৃহস্থালি কাজে বছরে সময় ব্যয় করেন ১৬ হাজার ৬৪১ কোটি শ্রমঘণ্টা।
তবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪, ১৫, ১৭, ২৮ (৪) ও ৩৪ অনুচ্ছেদ গৃহশ্রমিকের অধিকার প্রচ্ছন্নভাবে হলেও রক্ষা করেছে। কেবল আইন করে বা আইন প্রয়োগ করে গৃহশ্রমিকের ওপর নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব নয়। মানবিক মূল্যবোধ, সহানুভূতি ও সামাজিক সচেতনতাই এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। পাশাপাশি সরকারি কিছু পদক্ষেপ নির্যাতন নিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে। আর সেই সঙ্গে গৃহশ্রমিকদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতনতা তাদের জন্য বয়ে আনতে পারে মুক্তির বার্তা।
 লেখাটি সমকালের ২৬-০২-২০১২ তারিখের নারীস্থান পাতায় প্রকাশিত।

No comments:

Post a Comment

Beyond the Gavel: The Twists of Prenatal Sex Detection

  In a recent decision, a divisional bench of the High Court Division (HCD) has imposed embargo on pre-natal sex detection in Bangladesh in ...