Sunday, October 1, 2017

শিভেনিং স্কলারশিপের খুঁটিনাটি!

কৃচ্ছতা সাধনের এই যুগে এখনো বৃটিশ সরকার সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীদের জন্যে বিলেতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ অব্যাহত রেখে যে স্বল্প সংখ্যক পূর্ণ তহবিল বৃত্তি চালু রেখেছে শিভেনিং স্কলারশিপ তার মধ্যে অন্যতম। মেধাবী ও নেতৃতে যোগ্যতাসম্পন্ন তরুণদের সারা পৃথিবী থেকে বাছাই করে এই বৃত্তির আওতায় যুক্তরাজ্যে এক বছর মেয়াদী স্নাতকোত্তর পড়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। সারা পৃথিবীতে অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন এবং মর্যাদাপূর্ণ এই বৃত্তি ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে বিশ্বের ১৪১ টি দেশের প্রায় ৭০,০০০ হাজার আবেদনকারীর মধ্য থেকে মাত্র  ১৭৬৫ জন যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স কোর্স করার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৭০০ আবেদনকারীর মধ্যে ১৬ জন এবছর শিভেনিং বৃত্তির জন্য মনোনীত হয়ে ইতোমধ্যে বৃটেনে তাদের পড়ালেখা শুরু করে দিয়েছেন।

মূলত যুক্তরাজ্য সরকারের ফরেন ও কমনওয়েলথ (এফসিও) অফিস এবং সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহযোগিতায় পরিচালিত এই স্কলারশিপে একজন শিক্ষার্থীকে তার পড়ালেখার পূর্ণ খরচ (১৮০০০ পাউণ্ড পর্যন্ত), বৃটেনে বসবাস ও জীবনধারণের জন্য এক বছর পর্যন্ত মাসিক ভাতা; নিজ দেশ থেকে যাওয়া ও আসার বিমান টিকেটসহ বিভিন্ন ভাতা এমনকি এই স্কলারশিপের আওতায় প্রযোজ্য ভিসা ফি মওকুফ এবং ভিসা পেতে যে মেডিকেল টেস্ট করা লাগে তার ফিও বহন করা হয়। অর্থাৎ এক বছরের পড়াশুনার প্রাসঙ্গিক মোটামুটি সমস্ত খরচ এই স্কলারশিপের আওতায় বহন করা হয়।

আবেদনের সময়ঃ শিভেনিং বৃত্তির জন্য মূলত অনলাইনে আবেদন চালু হয় আগস্ট মাসে (এবছর ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের জন্য আবেদন চালু হয়েছে ৭ আগস্ট থেকে যা চলবে চলতি বছরের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত) এবং ক্লাস শুরু হয় পরবর্তী বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। তাই মোটামুটি এক বছরের দীর্ঘ প্রক্রিয়া হিসেবে ধরে নেয়া যায় একে। আগে বৃটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে হলেও এখন স্বতন্ত্র সচিবালয় ও স্থানীয় হাই কমিশনের মাধ্যমে পুরো বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
আবেদনের যোগ্যতাঃ শিভেনিং যেসমস্ত দেশের নাগরিকদের বৃত্তি দেয় সেসব দেশের যেকোন একটির নাগরিক হতে হবে। বাংলাদেশীরা সে তালিকায় আছে; তবে বৃটেনে দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকলে তিনি এক্ষেত্রে বিবেচিত হবেন না। ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হবে, যা দিয়ে বিলেতের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হওয়া যায়। কমপক্ষে দুই বছরের কাজে অভিজ্ঞতা লাগবে; তাই সদ্য স্নাতক পাস করা ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ আবেদনের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন না; যদিনা ছাত্রাবস্থায় কাজের অভিজ্ঞতা (ইন্টার্নশিপ, তবে কোর্স সম্পন্ন করার জন্য নয়; পূর্ণকালীন; খণ্ডকালীন; মজুরির বিনিময়ে বা ছাড়া, যাই হোক না কেন) বা স্বেচ্ছাসেবার দুই বছরের অভিজ্ঞতা না থাকে। বৃটেনে কাজের অভিজ্ঞতা গণনা করা হয় ঘণ্টা হিসেবে তাই দুই বছরের অভিজ্ঞতা প্রমাণে ন্যূনতম ২৮০০ ঘণ্টা কাজের অভিজ্ঞতা দেখাতে হবে।

তবে বৃটিশ হাই কমিশন, বৃটিশ কাউন্সিল, এ্যাসোসিয়েশন অব কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিস বা বৃটিশ সরকারের কোন প্রতিষ্ঠানের সাবেক বা বর্তমান কর্মী বা তাদের আত্মীয় এই বৃত্তির আওতাভুক্ত হবেন না। বাংলাদেশী আবেদনকারীদের ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা প্রমাণে অবশ্যই আইইএলটিএস-এ গড়ে কমপক্ষে ৬.৫ (তবে কোন মডিউলেই ৫.৫ এর কম না) থাকতে হবে (এক্ষেত্রে আপনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চান সেখানে স্কোর আরও বেশি চাইলে তা পেতে হবে)। শিভেনিং-এ আবেদন করার একটা বড় সুবিধা আবেদনের সময়ই আইইএলটিএস স্কোর ওয়েবসাইটে আপলোড করা লাগে না। স্কলারশিপের জন্য শর্তাধীনভাবে বিবেচিত হওয়ার পর এবছর সর্বশেষ ১২ জুলাই পর্যন্ত তা আপলোড করা যাবে। তবে প্রস্তুতি নিতে হবে আগে থেকেই। শিভেনিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল ডিগ্রি শেষে নিজ দেশে কমপক্ষে দুই বছর অবস্থান করা।
পড়ার বিষয়ঃ আপনি যে বিষয়ে পড়তে ইচ্ছুক শিভেনিং এর তালিকাভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫০০ স্নাতকোত্তর কোর্স থেকে যেকোন তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে আবেদনের সময়ই ঠিক করে দিতে হবে। চাইলে আপনি একই বিষয় তিনটি ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্ধারণ করে দিতে পারেন বা তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ও হতে পারে। এক্ষেত্রে আপনি যেসব বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দের তালিকায় ঠিক করে দিচ্ছেন তাদের যেকোন একটি থেকে বিনা শর্তে ভর্তির অফার লেটার জোগাড় করতে হবে। তাই আবেদন করার পাশাপাশি একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গেও ভর্তির ব্যাপারে যোগাযোগ করা ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মূলত বিষয় পছন্দ করে অনলাইনে আপনার পূর্বের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও আইইএলটিএস-এর স্কোর পাঠানোর প্রয়োজন পড়ে। শর্তাধীনভাবে বৃত্তি পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে জানালে বিনা খরচে ও শর্তে অনলাইনে অফার লেটার পাঠিয়ে দেয়া হয়, যা দেখিয়ে আপনি চূড়ান্তভাবে শিভেনিং বৃত্তি পেতে পারেন। এমনিতে পূর্বের কোন বৃটিশ ডিগ্রি থাকলে কোন অসুবিধা নেই তবে বৃটিশ সরকারের কোন বৃত্তি পেয়ে পড়ে থাকলে শিভেনিংয়ের জন্য আর আবেদন করা যায় না।
আবেদনে পূর্ণতা আনার জন্য দুইটি রেফারেন্স লেটার আপলোড করা লাগে; তবে তা প্রাথমিক বাছাইয়ের পর ইন্টারভিউয়ের জন্য বিবেচিত হলে ইন্টারভিউ বোর্ডে বা তার আগে নির্ধারিত ওয়েব পেইজে আপলোড করা যায়। রেফারেন্স লেটারে একাডেমিক ও প্রফেশনাল দুই ধরণের সমন্বয়ই থাকতে পারে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে শিভেনিং যেহেতু নেতৃত্বদানে যোগ্যতাসম্পন্নদের স্কলারশিপ দিয়ে থাকে তাই রেফারেন্স লেটারে যেন আপনার সে যোগ্যতা প্রয়োজনে উদাহরণসহ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এক্ষেত্রে তাই আপনি যাঁর নিকট থেকে রেফারেন্স লেটার সংগ্রহ করবেন তাঁকে আপনার ও শিভেনিংয়ের চাহিদা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে যেন আপনার কাঙ্ক্ষিত সমস্ত দিক সেখানে উঠে আসে।
বৃত্তি পেতেঃ শিভেনিং বৃত্তি পেতে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর (যদি কারও করা থাকে) পর্যায়ে অসাধারণ ফলাফল খুব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয় না; এমনকি আপনি সরকারি না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন তাও বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং আপনি যে বিষয় এখন পড়তে ইচ্ছুক তার সঙ্গে আপনার পূর্বের পড়ালেখা বা কর্মের সংযোগ; ইংরেজি ভাষায় লিখতে ও গুছিয়ে বলতে পারার ভালো দক্ষতা; ভবিষ্যৎ কর্ম পরিকল্পনার সঙ্গে আপনি যে বিষয়ে পড়তে চাচ্ছেন তার প্রাসঙ্গিকতা এবং তার সঙ্গে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে সরকারের অগ্রাধিকার ক্ষেত্রের সঙ্গতি প্রভৃতি বিষয়ের উপর জোর দেয়া হয় বেশি। তাই আবেদন করার পূর্বে বাংলাদেশে যুক্তরাজ্য হাই কমিশনের ওয়েব পেইজ থেকে অগ্রাধিকার ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করতে পারলে ভালো হয়। শিভেনিংয়ের ওয়েব সাইটেও দেশভিত্তিক অগ্রাধিকারের বিষয়গুলি উল্লেখ থাকে।
অনলাইন আবেদন ফর্মে নিজের সম্পর্কে তথ্য, যোগাযোগের ঠিকানা, শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রভৃতি বিষয়ের পাশাপাশি নিজের জীবনের উদাহরণসহ ৫০০ শব্দের চারটি প্রবন্ধ লিখতে হয়; নেতৃত্ব ও অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা; নেটওয়ার্কিং দক্ষতা; আপনি পড়ার জন্য যে বিষয় নির্ধারণ করেছেন তার সঙ্গে আপনার পূর্বের পড়ালেখা ও কর্মের সংযোগ এবং সে বিষয়ের উপর ভবিষ্যৎ ভাবনা ও আগামীর কর্ম পরিকল্পনা এই চারটি বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতে হয়। আপনি বাছাইয়ের পরবর্তী পর্যায় অর্থাৎ ইন্টারভিউয়ের জন্য বিবেচিত হবেন কিনা তা মূলত নির্ধারণ করে এই চারটি প্রবন্ধে কত চমৎকারভাবে বাস্তব উদাহরণসহ বক্তব্য উপস্থাপন করা হচ্ছে তার উপর। তাই সময় নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে একেবারেই নিজের কথাগুলি সাজিয়ে এখানে লেখা উচিৎ। কারও পূর্বের আবেদনপত্র দেখে বা কোন ওয়েব সাইটের সাহায্য নিয়ে না লেখাই ভালো। তাতে স্বকিয়তা বজায় থাকবে বেশি এবং অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার আশংকাও কমে যাবে। তাছাড়া আপনি নিজেই নিজের বক্তব্য সবচেয়ে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন; যা অন্যের দ্বারা সম্ভব না। এছাড়া ইন্টারভিউ পর্যায়ে মূলত এখান থেকেই প্রশ্ন করা হয়। তাই তখন আপনার দ্বারা সবকিছু ব্যাখ্যা করাও অনেক সহজ হবে। আপনাকে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থকে সব সময় সবার আগে প্রাধান্য দিয়ে হবে। প্রবন্ধগুলিতে খুব ভালোভাবে নিজের জীবনের উদাহরণ সহকারে নেতৃত্বের গুণাবলী ও অন্যান্য বিষয়সমূহ তুলে ধরতে হবে।

No comments:

Post a Comment

The Necessity of Reforming the International Crimes Tribunals Law of Bangladesh for Fair Trial

  The present interim government of Bangladesh has decided to try the former ousted prime minister Sheikh Hasina before the International Cr...